Wednesday, March 24, 2010

জল রঙ স্বপ্ন ও একটি ফড়িং

"মা এর থেকে মামা কেন বেশি ভালো বল্ তো?" মামা জিজ্ঞেস করে ।

"কারণ মা এ একটা মা, মামায় দুইটা মা!" নাইশা বলে ওঠে ।


মামা বাসায় আসলেই নাইশার খুব ভালো লাগে। মামা শুধু ভালো ভালো গিফট দেয় সেই কারণে না, বেড়াতে নেয় সেই কারণে না, মামা অন্য বড়দের মত সারাক্ষণ বড়দের মত করে কথা বলে না! মামা তো ওর সাথে খেলেই তারপর মজার মজার কথা বলে । নাইশার ফ্রেণ্ডরা তো ওকে হিংসা করে ওর মামার জন্য। অবশ্য মামাকে ওদের ফ্রেণ্ডদের সামনে আনা যাবে না । মামা ওকে হয় আম্মু অথবা বুড়িডাকে। ফ্রেণ্ডরা যদি শোনে ওকে বুড়ি ডাকা হয় তাহলেই হয়েছে! দেখা যাবে স্কুলে ওর নাম ই হয়ে যাবে বুড়ি! ক্লাস ফাইভে উঠেছে সে এবার । এত বড় একটা ক্লাসের মেয়েকে কেউ বুড়ি ডাকে?!

"মামা আমাকে বুড়ি ডাকবে না কতবার বলেছি!"

"সরি বুড়ি!" বলেই মামা হাসে।

নাহ! মামাকে নিয়ে পারা যায় না! নাইশা ভাবতে থাকে । নিলয় ফাযিলটা নেই এখন। ঠিক হয়েছে । খালি ক্রিকেট খেলতে চায় মামা এলেই । ক্লাস থ্রিতে পড়ে তবুও মাথায় যদি একটু বুদ্ধি শুদ্ধি থাকত! এখনো ছোটই রয়ে গেল! নিলয় এর শুধু বুদ্ধিশুদ্ধি ই কম না , ও একটা আস্ত শয়তান! নাইশা ওর বড় তাও ওকে নাম ধরে ডাকে! কত্ত বড় ফাযিল!
আম্মু নিলয়কে স্কুল থেকে আনতে গেছে । নাইশার আজ স্কুল নেই ।মামার ও অফিস নেই । মামা অনেক দিন পর এলো ওদের বাসায় । মামার নাম সাব্বির । আম্মু ডাকে সাবু! (ভাগ্যিস ওকে আম্মু নাশু ডাকে না!) মামা অনেক কমিক্স নিয়ে আসে । চাচা চৌধুরী পড়া শেষ হয়ে গেছে ওর । ৩ টা টিনটিন ও পড়ে ফেলেছে । চাচা চৌধুরী পড়ে একটা কার্টুন ও এঁকেছে সে। ছোঁচা চৌধুরী আর সাবু!
ছোঁচাটা হচ্ছে নিলয়!(এত পেটুক! সারাক্ষণ খালি খাওয়ার কথা বলে!)
মামা ছবিটা দেখে খুব খুশি হয়েছে । যদিও বলেছে মামার নাকটা নাকি বোঁচা হয়ে গেছে! ছোঁচা চৌধুরী আর বোঁচা চৌধুরী! নাইশা ফিক করে হেসে দিল ।

নাইশার ছবি আঁকতে খুব ভালো লাগে , বিকেল গুলোতে ফাঁক পেলেই সে ছবি আঁকে । আগে শুধু গ্রামের দৃশ্য টাইপ ছবি আঁকত । এখন অনেক কিছু আঁকে । আটলান্টিক এর নীচের ছবি, মহাকাশের ছবি, মেঘের ছবি। মামা বলেছে যত বেশি আলাদা আঁকা যায়। ভুলেও অন্যদের মত আঁকা যাবে না । সে তাই ছবি আঁকার আগে অনেক ভাবে । ছবির জন্য ভাবতেও তার অনেক ভালো লাগে ।

ছবি ভালো হলেই দেয়ালে ঝুলিয়ে দেয় । নাইশা আর নিলয় যে রুমটায় থাকে তার ডানপাশের দেয়ালটা নাইশার আর বাম পাশের টা নিলয় এর। (ওর দেয়ালে খালি স্পাইডারম্যান এর ছবি। গাধার গাধা! বড় হয়ে স্পাইডারম্যান হতে চায়! এমন বোকা লোক আর একটাও আছে?! সুপারম্যান তো না সুপার গাধা! )

ওদের পাশের বাসায় একটা ফুলের বাগান আছে । নাইশারা দোতলায় থাকে ।ওদের বারান্দা দিয়ে ফুলগুলো দেখা যায় । এত সুন্দর! নাইশার খুব ইচ্ছে করে ফুল গুলো চুরি করে নিয়ে আসতে! মামাকে ওর প্ল্যান এর কথা বলল । মামা বলল "ফুল গাছে থাকাই ভালো । ফুল ছিড়লে গাছের কষ্ট হবে। " এর চেয়ে কাগজের ফুল নাকি ভালো!নষ্ট হবার ভয় নেই । কষ্ট হবার ও ভয় নেই! মামা একটা ফুল বানিয়ে দিয়ে বলল,রঙ করে ফেল । এই বাগানের ফুলগুলোতে অল্প ধরণের রঙ আছে , ওকে অনেক ধরণের রঙ লাগাতে বলল । নাইশা মোম রঙ ব্যবহার করে । মামা অবশ্য ওকে জল রঙ কিনে দিবে পরের সপ্তাহে । কী মজাটাই না হবে! এবার কল্পনার সব রঙ মিশিয়ে ছবি আঁকা যাবে! (কথাটা মামার ! মামা খালি কল্পনা করার বলে, বাবার ঠিক উলটো! বাবা ওর ছবি দেখে বলে "কী সব হাবিজাবি!" দেখা জিনিস আঁকতে বলে । মামাকে বাবার কথা বলল সে । মামা বললো কল্পনারটাও নাকি এক প্রকারেরদেখা! এত কঠিন কথা নাইশা বোঝে না ।সে শুধু বোঝে তার আঁকতে ভালো লাগে। জল রঙ পেলে অনেক ভালো ছবি আঁকা যাবে ।)

নিলয় আর আম্মু আজ বেশ লেট করে বাসায় আসলো ।

"নাইশা... নাইশা... তোমার নতুন টিচার এর বাসায় গিয়েছিলাম আজ । অনেক বড় বেত আছে সেই টিচার এর!টিচার এর ইয়া বড় পেট ! হিহি হাহা। অনেক রাগী । তার মোছটাও রাগী রাগী!! তুমি না পড়লে তোমাকে মাইর দিবে আর মোছ টানবে!" এই বলে বিশ্রি করে একটা হাসি দিল! নিলয়টা এত্ত ফাযিল! নাইশার ক্ষতি হলে এত আনন্দিত হয় !
আম্মু মামাকে দেখে খুশি হয় । একমাত্র ছোট ভাইকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ।

দুপুরে খাওয়ার সময় নাইশা আম্মুকে বলে
"আম্মু মামা আগামী সপ্তাহে জল রঙ এনে দিবে! কী মজা! "
"কী?! না না! জল রঙ কিনে দিস না সাবু ,ওতো এ বছর ছবি আঁকার সময় ই পাবে না । ছবি আঁকা নিয়েই থাকতে চাবে। বিকেল বেলা ঘুমানো দরকার । সমাপনী পরীক্ষা না সামনে ! ৩ টা টিচার... "

আম্মু আরও অনেক কিছু বলতে থাকে । নাইশার কানে ঢোকে না । ও জানে সব । ইদানিং সারা দিন ই ওকে পড়ার উপর থাকতে হয় । এখন আরেকটা নতুন টিচার !
আম্মুর মামাকে বলে "তুই এর চেয়ে বড় দেখে একটা ব্যাগ গিফট কর। ওর নতুন কেনা ব্যাগ টাও ছোট হয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে । এত বই ওর! "

নাইশার এত্ত মন খারাপ হল । জল রঙ এর বদলে ব্যাগ! এটা কোন কথা হল ?
মামা আম্মুকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করে এতটুকু বাচ্চার উপর এত প্রেশার দেয়া ঠিক না , আম্মু শোনে না । মামা আর আম্মু তর্ক করতে থাকে ।

নাইশা খাওয়া শেষ করে ওর রুমে চলে যায় । ওর মনটা খারাপ হয়ে গেছে । সমাপনী পরীক্ষাটার উপর সব রাগ চাপে ওর । জল রঙ তো পাবেই না, উলটো ওর ছবি আঁকা বন্ধ হবে । নতুন টিচার এর কাছে পড়তে গেলে ও তো আর সময় ই পাবে না ছবি আঁকার ।
সদ্য রঙ করা কাগজের ফুলটা নিয়ে ওর বিছানায় শুয়ে পড়ল । নিলয় বারান্দায় গিয়ে ফড়িং ধরতে লাগল । পাশের বাগান থেকে মাঝে মাঝেই ফড়িং চলে আসে ওদের বারান্দায়। আর ফাযিল নিলয় সেই ফড়িং গুলো ধরে, মাঝে মাঝে তো সুতো দিয়ে বাঁধে ! আচ্ছা ও এত পাজি কেন ?

আম্মু এসে বলল "আম্মু একটু চাপো তো ।" ওর বিছানায় উঠে আগের টাঙানো একটা ছবি খুলে ফেলল।

স্কচটেপ দিয়ে নতুন একটা ছবি টাঙাতে শুরু করল ।

"এটা কি আম্মু?"

"তোমার বিজ্ঞান বই এর একটা ছবি । অঙ্কুরোদগমের ছবি । তুমি সামনে পড়বে এটা । চোখের কাছে ছবি থাকলে তাড়াতাড়ি পড়া হয়ে যাবে। পরে দেখে নিও । এখন ঘুম দাও তো । বিকেলে টিচার এর কাছে যেতে হবে। "

আম্মুর ছবি টাঙানো শেষ হলে নিলয়কে "নিলয় ঘুমুতে যাও"বলে চলে গেল ।

অঙ্কুরোদগম । কী কঠিন শব্দরে বাবা! ওর মেঘের ছবিটা খুলে এত পচা একটা ছবি টাঙানো হয়েছে! ছবিটায় কী বিশ্রি রঙ! ছবি আকাও বন্ধ ,সাথে টাঙানো ও বন্ধ ! মেঘের ছবিটা ভাঁজ করে বালিশের পাশে রেখে দেয় ।

"নাইশা! নাইশা!দেখো না । আরেকটা ফড়িং ধরেছি !" নিলয় চেঁচাতে থাকে । নিলয়টা না খুব খারাপ!সে সুন্দর ফড়িংগুলো ধরে আর পাখা কেটে দেয় ।
নিলয় বলতে থাকে "নাইশা ,এই নাইশা দ্যাখো না। ফড়িংটা তবুও বেঁচে আছে !"
নাইশা চুপ করে শুয়ে থাকে , জবাব দেয় না ।
গন্ধহীন,কাগজের ফুলটা হাতে নিয়ে ডানা কাটা ফড়িংটার জন্য কষ্ট পায় সে,অনেক কষ্ট ।


উৎসর্গ : নামে ছোট্ট, হৃদয়ে বিশাল, কাজে অক্লান্ত, স্বপ্নে অনন্যা ।

4 comments:

mahmud said...

খুব সুন্দর লেখার ধরন...
আমি মুগ্ধ হলাম...
আগামীতে নিয়মিত চোখ রাখব আশা করছি....

বোহেমিয়ান said...

অনেক অনেক ধন্যবাদ । ভালো থাকুন ।

সাঝবাতির রুপকথা said...

ছেলেটা কি জানে যে ছেলেটা খুব ভালো লিখে?

Bappy said...

অনেক ধন্যবাদ সাঝু ভাই!

খুব খুব ভালো লাগল