Wednesday, February 10, 2010

অ্যালগোরিদম-ই ভালবাসা, অ্যালগোরিদমেই ভালবাসা !

বন্দী থাকলে মন মুক্ত হতে চায়! জেলে বসে "ফেরদৌস শাকিল রাজু" তা ভালই টের পাচ্ছে । সারা জীবন কম্পিউটার এর সামনে বসেই কাটিয়েছে সে। এখন জেলে এসে তার ইচ্ছে করছে বাইরে যেতে !এটি তার দ্বিতীয় কারাবাস । ছাত্র থাকাবস্থায় হ্যাকিং এর কারণে প্রথমবার জেলে ছিল কিছুদিন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারও হয়েছিল ।

জেলে থেকে বেরুবার পরই জব পেয়েছিল সরকারের প্রধান নিরাপত্তা সংস্থায়! "অ্যালগরিদম ই ভালবাসা " -এই ছিল শাকিল এর জীবনের মূল মন্ত্র । ডিক্রিপশনের উপর তার অ্যালগোরিদম একটি ব্রেকথ্রু হিসেবেই গণ্য হয় । 
জেলে বসে সে ভাবতে থাকে পেছনের কথা । দিনের বেশির ভাগ সময় সেলে বন্দী থাকে । শুধু খাবার এর সময় টুকুতে অন্যদের সাথে একসাথে বসতে পারে । এই সময়টা সে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে ।
অন্য কয়েদীদের সাথে গল্প করে । অথচ যখন সে মুক্ত ছিল , মানুষের সঙ্গ
তার ভালই লাগত না! একমাত্র সুজানার ছাড়া! 
সুজানা হচ্ছে শাকিল এর দেখা সেরা সুন্দরী ! যাকে সে হৃদয়বতী বলে ডাকত । অথচ ওর বন্ধুরা সুজানাকে দেখে কখনোই বলে নি "আহা মরি" টাইপ সুন্দরী । 
শাকিল এর নাকি শ্বাস বন্ধ হয়ে যায় সুজানার কাছে গেলে!
সেই সুজানার সাথে শাকিল এর দেখা হয়েছিল কাকতালীয় উপায়ে । 
শাকিল এই ঘটনা বলতে সে মজা পায় । তার খুব ভাল লাগে সুজানার কথা বলতে।জেলে তার সবচেয়ে মনোযোগী শ্রোতা মবিন । 
মবিন হচ্ছে ব্যাঙ্ক ডাকাত । তবে কোন বার ই সফল হয় নি ।
তৃতীয় বারের মত ধরা পড়ে জেল খাটছে । মবিন এর বাবাও ব্যাঙ্ক ডাকাত ছিল! তবে তার বাবা সফল ব্যাঙ্ক ডাকাত ছিল । তিন বার ডাকাতি করেও ধরা পড়ে নি।
সেই কাহিনী মাঝে মাঝেই সে শাকিলকে বলে । সে তার বাবার মুখ রাখতে পারল না! ব্যাঙ্ক ডাকাতিই তার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান! 
মবিন শাকিল এর হ্যাকিং এর কাহিনী জানার পর তাকে মাঝে মাঝেই বলে "চল জেল থেকে বাইর হওনের পর আমরা দুই দোস্ত মিলা ব্যাঙ্ক ডাকাতি করি!তোমার বুদ্ধি আমার শক্তি! এই বার লালে লাল হয়া যামু ।"
মবিনের চোখ মুখ ২০০ ওয়াটের বাতির মত জ্বল জ্বল করলেও শাকিল তাতে সাড়া দেয় না । বয়সে মবিন ,শাকিল এর ১২/১৫ বছরের বড় হলেও যে তাকে বন্ধুর মত দেখে এই বিষয়টা শাকিল এর ভালই লাগে। 

শাকিল তার কাহিনী মবিনকে বলে । কিভাবে তার সাথে সুজানার পরিচয় হয়েছিল। 
"সব সময় কি ঘরে বসে থাকতে ভাল লাগে ? এক বৃহস্পতি বার 
গিয়েছিলাম মুভি দেখতে । তাও নিজের শহরে না । কয়েক ঘণ্টার পথ পার করে আরেক শহরে ।"
"কি মুভি?যে এইটা দেখার জন্য এত দূর গেলা ? "সামান্য মুভি দেখার জন্য শহর অতিক্রম?! মবিন বিরক্ত হয় । ব্যাঙ্ক ডাকাতি হলেও না হয় একটা কথা ছিল ! অন্য শহরে করলে ধরা পড়ার রিস্ক কম! 
" Ruebah Rudypen এর মুভি । রোমান্টিক মুভি"
"হায়রে রুমাণ্টিকুতা! কইতে থাকো " মবিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে । 
"অদ্ভুদ ব্যাপার হচ্ছে সিনেপ্লেক্স এর বুকিং সিস্টেমে কোন সমস্যা হয়েছিল সে দিন। আমাকে যেই সিট দেয়া হয়েছিল ,সুজানাকেও সেই সিট ! আমি গিয়ে বসেছিলাম নিজের সিটে। বসার পর দেখি পরীর মত দেখতে ।যাকে বলে শ্বাসরুদ্ধকর ... (এই পর্যায়ে মবিন মাথা হতাশভাবে নাড়ায়। সুজানার ছবি সে দেখেছে। এত সুন্দর বলার কোন মানে সে খুঁজে পায় না । সাদামাটা মেয়ে। কিন্তু এই ছেলে যে গভীর প্রেমে পড়েছে । সুযোগ পেলেই তার প্রেমিকার বর্ণণা দিতে থাকে )
"...সুন্দর একটা মেয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াল । এসে বলছে এক্সকিউজ মি আপনি কি ঠিক সিট এ বসেছেন? আমার টিকেটে এই সিটের নাম্বার লেখা আছে!"
শাকিল সে দিন মুভিটি মিস করেছিল মেয়েটির জন্য । মবিন ভাবে "আহারে । ভালুবাসা! আমার জীবনে ক্যান আসল না! সব ই কপাল। নাইলে কি ব্যাঙ্ক ডাকাতিতে এত বার সে ধরা খায়? 
বাস এর টিকেট এর কারণে সে তৃতীয় বার ধরা পড়েছিল। আর নাহলে বাকি সব কাজ সে ঠিক ই করেছিল। একজনের টিকেট এর ভুলে প্রেম হয়। আরেকজনের হয় জেল! সব ই কপাল!"
তার পর আরেক দিন দেখা হয় একটি শপিং মলে , সুজানা
শাকিল কে দেখেই চিনতে পারে, সেই দিন এর জন্য ধন্যবাদ জানায়।
সেই সুযোগ শাকিল লুফে নেয় । কফিশপে দু জন বসে...তার পর দু জনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে । 
সুজানা শাকিল এর সব কিছুতেই প্রচণ্ড মু্গ্ধ হত। 
সুজানার ঠিক পছন্দের কাজ গুলোই শাকিল করত। ওর পছন্দের উপহার এনে দিত,ওর পছন্দের জায়গায় নিয়ে যেত । শাকিল কি করে যেন সুজানার পছন্দ টের পেয়ে যেত ।
সব কিছুই ঠিক চলছিল কিন্তু হঠাৎ শাকিলকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল। 
শাকিল সরকারী ডিএন এ ডাটাবেইজ এ হ্যাকিং করেছিল। 
খোঁজ নিয়ে জানা গেল শাকিল সুজানার ডিএনএ ম্যাপিং চুরি করেছিল! এর ফলে সুজানার সব পছন্দ সে জানত! এ ভাবেই
সে সুজানাকে মুগ্ধ করত ! 
ধরা পড়ার পর জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা ওর চাকরি বাতিল করে দেয়।
সুজানাও ওর সাথে সম্পর্ক শেষ করে দেয় । 
মবিন এর কান্না পেয়ে যায়। আহারে । পোলাডার কপালটাও ফাটা!
ওরে নিয়া ব্যাঙ্ক ডাকাতি কইরা লাভ নাই। আবারো ধরা খাইতে হইব! 
"কিন্তু তুমি ধরা খাইলা কেমতে? তাও এত দিন পর?" 
শাকিল একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে বলে "আমি আসলে ইচ্ছে করে ধরা
দিয়েছি! আমি ইচ্ছে করে প্রমাণ রেখে এসেছিলাম যে সেই কাজ আমি ই করেছি!তাই এত দিন পর ধরা খেয়েছি!! "
"কি!?!!কেন?!!" মবিন এর চোখ কপালে উঠে যায় । 
"যাতে আমি জেলে যাই! এবং সুজানা আমাকে বিয়ে করে!"
"কি কও এই সব আবোল তাবোল?!! ও তো তোমার সাথে ব্রেক আপ কইরা দিছে আর তুমি দুই মাস ধইরা জেলে পচতাছ। একটা চিঠিও দেয় নাই। বিয়া হইবো কেম্নে?" 
"সুজানার ডিএনএ ম্যাপিং দেখেই এই কাজটা করেছি। ওর জন্য সব যে ছাড়তে পারবে তাকেই সে গ্রহণ করবে! আমি তাই ওকে দেখিয়ে দিলাম ওর জন্য আমি সত্যি সব করতে পারি!" 
"খাইছে!! তুমি তো মানুষ ভালা না! মেয়ে পটানোর জন্য জেলে পর্যন্ত ঢুকছ! তোমারে দিয়াই হইব !"
শাকিল বলে "কি ব্যাঙ্ক ডাকাতি?"
" না প্রেম!" মবিন হেসে ফেলে । 
শাকিল ও হাসতে থাকে । 

২। 

শেষ পর্যন্ত শাকিল এর ধারণাই সত্যি হল । সুজানা তিন মাসের মাথায় শাকিল এর সাথে দেখা করতে এল । এসেই কি কান্না! শাকিল 
এর তখন মনে হয় ওর জীবন সার্থক । 
অ্যালগোরিদম এর অপর নাম সুজানা!
ওরা ঠিক করে শাকিল জেল থেকে বেরুলেই বিয়ে করবে ।
মবিন সব শুনে তো মহা খুশি । "বিয়ের কার্ড পাঠাইবা বুঝছো? 
যাইতে না পারি। কার্ডটা নিয়া আনন্দ ভাগাভাগি করুম । গিফট ও পাঠামুনে। ব্যাঙ্ক ডাকাতির ট্যাকা না। বাপের ট্যাকা ...সেইটাও অবশ্য ব্যাংক ডাকাতির...কিন্তু এত দিনে সেই টাকা সাদা হয়া গেছে!! " 
৩।
শাকিল প্রহর গুনতে থাকে কবে বেরুবে । 
শাকিল এর সাথে জেলে দেখা করতে আসে সরকারের প্রধান নিরাপত্তা সংস্থার ক্রিপ্টোগ্রাফি বিভাগের প্রধান । 
শাকিল তো নিজের চোখ কে বিশ্বাস করতে পারে না । 
"কেমন আছ শাকিল?" 
"ভাল নেই স্যার । জেলে কি ভাল থাকা যায়?" 
"একটা বিষয় নিয়ে কথা বলতে এসেছি। সরকারী ডিএনএ ডাটাবেইজএ তোমার হ্যাকিং এর পর তদন্ত করতে গিয়ে কত গুলো বিষয় নজরে এসেছে । এর আগেও দুইবার হ্যাক হয়েছে সেই সাইট । কিন্তু হ্যাকারকে ট্রেস করা যায় নি । আরো একটি গুরুতর সাইট ও হ্যাক হয়েছিল কয়েক মাস আগে । তা হচ্ছে ডিএনএ ম্যাপিং এর উপর বেইজ করে ডিএনএ ম্যাচিং 
(পার্ফেক্ট কাপল খুঁজে বের করার জন্য) এর সাইট । সেই সাইট টির অস্তিত্ব আমি নিজেই জেনেছি গতকাল । এটি খুব গোপনীয় একটি সাইট । এর কোন কিছুই মিডিয়ায় লিক হলেই সরকার আর নিরাপত্তা সংস্থা সহ অনেক সংস্থাই বিপদে পড়ে যাবে । এখন পর্যন্ত হ্যাকার এর কোন ট্রেস পাওয়া নি । আমাকে হ্যাকিং এর তারিখগুলা 
জানাতেই আমি মিলিয়ে দেখলাম তুমি সুজানার সাথে প্রথম যে দিন
সিনেমা হলে দেখা করেছিলে তার মাত্র এক সপ্তাহ আগের ঘটনা! সেই সিনেমা হলের সিট নিয়েও একটা হ্যাকিং হয়েছিল! তুমি বুঝতে পারছ আমি কি বলতে চাচ্ছি?"
শাকিল কিছু বলল না । মুখটা যতটা সম্ভব নির্বিকার রাখার চেষ্টা করল । ( অ্যালগোরিদমেই ভালবাসা! )
" সুজানার সাথে তোমার পার্ফেক্ট ম্যাচিং এর পেছনে ডিএনএ ম্যাচিং এর কারণেই হয়েছে! তুমি জান আমি তোমার বিরুদ্ধে কিছু করব না চাইলেও পারব না ।কারণ কোন শক্ত প্রমাণ নেই । তুমি এত গুরুত্বপূর্ণ দুইটি সাইট ট্রেস বিহীন হ্যাক করেও টাকা বা অন্য কিছুর পেছনে ছোট নি দেখে তোমাকে ডিএনএ এনালিসিস ডিপার্টমেণ্ট এর প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে এবং তোমার মুক্তির আদেশ ত্বরান্বিত 
করা হয়েছে । পরশু দিন তুমি মুক্তি পাচ্ছ !" 
৪। 
শাকিল মবিন কে বলল নতুন চাকরি আর মুক্তির কথা (আগের হ্যাকিং এর কথা চেপে গেল)। 
সব শুনে সে বলল "এরেই কয় কপাল!!" মবিন তার ফাটা কপাল নিয়েও আনন্দ করতে লাগল । 
শাকিল কিছু বলল না । একটু হাসল । শুধু মনে মনে বলল 
"অ্যালগোরিদম-ই ভালবাসা, অ্যালগোরিদমেই ভালবাসা !" 

ঠ্যাংনোটঃ 
*ফেরদৌস, শাকিল ,রাজু আমার তিন বন্ধুর নাম । ওরা আমার লেখা পড়ে না, আগামীতে পড়বে সেই সম্ভাবনাও নাই। লেখাটি ওদেরকেউৎসর্গ করলাম । 
*Ruebah Rudypen নামটি Audrey Hepburn এর অ্যানাগ্রাম। 


ছবি কৃতজ্ঞতা

2 comments:

জনৈক আরাফাত said...

এই লেখাটা আসলেই দারুণ হয়েছিলো!

বোহেমিয়ান said...

থ্যাঙ্কু আরাফাত ভাই । আপনার কমেন্ট অনেক দেরিতে চোখে পড়ল ।